বাংলাদেশের জনসংখ্যা প্রায় সাড়ে ১৬ কোটি এবং জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ১.২৬%। জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে বাড়তি জনসংখ্যার চাপে উন্নয়ন কর্মকাণ্ড ও বসতি স্থাপনের ফলে চাষাবাদের জমি কমে যাচ্ছে। জনসংখ্যার আধিক্যের কারণে চাহিদার তুলনায় উৎপাদন বৃদ্ধি করা যাচ্ছে না। ফলে খাদ্য ঘাটতি থেকে যাচ্ছে। খাদ্য দ্রব্যের ক্রয়মূল্য অত্যন্ত বেশি হওয়ায় সকলের পক্ষে পুষ্টি সম্পন্ন খাদ্য কিনে খাওয়া সম্ভব হচ্ছে না। পর্যাপ্ত খাদ্যের অভাব এবং অজ্ঞতার কারণে অনেকে হাতের কাছে যা পায় তাই খেয়ে ক্ষুধা মেটানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু শরীর সুস্থ রাখার জন্য খাদ্য নির্বাচনের যে একটা প্রয়োজন আছে তা বিবেচনা করা একান্ত দরকার । শরীরের চাহিদা অনুযায়ী খাদ্য খাওয়া উচিত অন্যথায় পুষ্টিহীনতায় ভুগে রোগাক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে ।
একজন লোকের দৈনিক ৭০-৭৫ গ্রাম প্রোটিন খাওয়ার দরকার। কিন্তু প্রোটিনের ঘাটতি থাকায় দিনের পর দিন প্রোটিন ও ক্যালরির অভাবে পুষ্টিহীনতা মানুষ ভুগছে। খাদ্যে প্রোটিন ও ক্যালরির একত্রে অভাবজনিত রোগকে প্রোটিন-ক্যালরির অভাবজনিত রোগ বলে। এ ধরনের পুষ্টিহীনতার শিকার হচ্ছে শিশু, অন্তসত্ত্বা ও স্তন্যদানকারী নারী এবং স্বল্প আয়ের লোকজন। অনেকে দীর্ঘদিন অপুষ্টিতে ভুগছে ভুগতে মারা যাচ্ছে । যারা বেঁচে থাকে তারা অসুস্থ, মেধাহীন ও কর্মে নিরুৎসাহী হয়ে থাকে। একপর্যায়ে তারা শারীরিক ও মানসিকভাবে শক্তিহীন হয়ে সমাজের বোঝা হয়ে বেঁচে থাকে। এছাড়া পুষ্টিহীনতা থেকে মানুষের ভিটামিনজনিত নানা রোগ হয়ে থাকে ।
পুষ্টিহীনতার কারণ— পুষ্টিহীনতাকে মোকাবেলা করার জন্য প্রথমে এর কারণ জানা প্রয়োজন। আমাদের দেশে পুষ্টির ঘাটতি বৃদ্ধির মূল কারণগুলো নিম্নরূপ-
১. দারিদ্র্য
২. ঘন জনবসতি
৩. অজ্ঞতা
৪. খাদ্যের পুষ্টিমান উন্নয়ন
৫. রন্ধন জ্ঞান
৬. সুষম খাদ্য তৈরি
৭. খাদ্য সংরক্ষণ
৮. কুসংস্কার
৯. খাদ্যে ভেজাল
১০. প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও
১১. স্বাস্থ্য পরিচর্যা
নিম্নে এ কারণগুলো বর্ণনা দেওয়া হলো :
১। দরিদ্রতা : পুষ্টিকর খাদ্য যেমন- মাছ, মাংস, ডিম, দুধ, মাখন, পনির, ঘি, ডাল ও তেল ইত্যাদির দাম বর্তমান বাজারে আকাশচুম্বী। জনসংখ্যার বৃহত্তম অংশই দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে বিধায় তারা পুষ্টিকর খাদ্য ক্রয় করতে পারে না ফলে পুষ্টিহীনতা দেখা দেয়।
২। ঘন জনবসতি : অত্যন্ত ঘনবসতি পূর্ণ বাংলাদেশে বর্তমানে প্রতি বর্গকিলোমিটারে জনসংখ্যার বসতি প্রায় ১০৬৩ জন। জনসংখ্যা বৃদ্ধির তুলনায় খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধি পাচ্ছে না। জনসংখ্যার এই ঊর্ধ্বগতির সাথে পাল্লা দিয়ে উৎপাদন বৃদ্ধি করে খাবার জোগান দেওয়া অত্যন্ত কঠিন কাজ। তাছাড়া প্রতিবছর ৮৭ হাজার হেক্টর কৃষি জমি উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের জন্য অকৃষি খাতে চলে যাচ্ছে। এভাবে আবাদি জমি হ্রাস এবং জনসংখ্যা বৃদ্ধি চলতে থাকলে খাদ্য ঘাটতি হবে, ফলে মারাত্মক পুষ্টিহীনতা দেখা দেবে।
৩। পুষ্টি বিষয়ক অজ্ঞতা : আমাদের দেশের অধিকাংশ লোকেরই খাদ্য নির্বাচন এবং রান্নার উপযুক্ত পদ্ধতি জানা নেই। এ কারণে দেখা যায় একই ধরনের খাদ্য অতিমাত্রায় গ্রহণ করার ফলে খাদ্যের অন্যান্য উপাদানের ঘাটতি সৃষ্টি হয়। শাকসবজি ও ফলের খাদ্যপ্রাণ সংরক্ষণ, পুষ্টিকর খাদ্য চিহ্নিতকরণ ও ব্যক্তি বিশেষের ক্যালরির চাহিদা, শিশু খাদ্য ও সূর্যালোকের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে জ্ঞান বা ধারণা না থাকার কারণে সাধারণ মানুষ পুষ্টিহীনতার শিকার হচ্ছে।
৪ । খাদ্যের পুষ্টিমান উন্নয়ন : খাদ্যদ্রব্য প্রক্রিয়াজাতকরণ ও পুষ্টিমানের উৎকর্ষ বৃদ্ধির মাধ্যমে খাদ্যের মান উন্নত করা সম্ভব যা পুষ্টি সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যেমন- গুঁড়া দুধের সাথে ভিটামিন ‘এ' ও 'ডি' সংযুক্তকরণ, গমের সাথে লাইসিন যোগ, লবণের সাথে আয়োডিন যোগ, মাড়সহ ভাত রান্না, আটার সাথে ভুট্টার আটা যোগ, তেল সহযোগে ক্যারোটিনসমৃদ্ধ শাক-সবজি রান্না ইত্যাদি। খাদ্যের প্রকারভেদ অনুযায়ী খাদ্যের সাথে বিভিন্ন দ্রব্য যোগ করে খাদ্যের পুষ্টিমানের বৃদ্ধিসাধনে দক্ষ থেকে হবে।
৫ । রন্ধন জ্ঞান : খাদ্য উপাদান অবিকৃত রেখে সঠিক পুষ্টি আহরণ ও রান্নার সঠিক পদ্ধতি সম্পর্কে জ্ঞান লাভের গুরুত্ব কম নয়। খাবার তৈরিতে বেশি মশলা, বেশি ঝাল, বেশি কষানো বা অল্প জ্বালে খাদ্যের পুষ্টি নষ্ট হতে পারে। এ ধরনের খাবার হজমে বাধা সৃষ্টি করতে পারে। তাপে ভিটামিন-সি নষ্ট হয়ে যায়। শাকসবজি সর্বদা ধুয়ে কাটতে হবে। রান্নায় কম পানি ব্যবহার করতে হয়। খাদ্য সর্বদা তাজা অবস্থায় রান্না করতে হয় ইত্যাদি জ্ঞানের অভাবে পুষ্টিহীনতা থেকে পারে ।
৬। সুষম খাদ্য : বয়স অনুপাতে বিভিন্ন ধরনের খাবার একত্রে মিশিয়ে সব ধরনের পুষ্টি প্রাপ্তির ব্যবস্থা করতে হবে। সুষম খাদ্যের কয়েকটি তালিকা পূর্বে দেওয়া হয়েছে।
৭। খাদ্য সংরক্ষণ : উৎপাদন মৌসুমে আলু, শাকসবজি, আম, কাঁঠাল, আনারস, লেবু, কলা ও অন্যান্য ফসল প্রয়োজনের অতিরিক্ত উৎপাদন হলে সংরক্ষণ সুবিধার অভাবে তা নষ্ট হয়ে যায়। পরিসংখ্যান মতে বাংলাদেশে গত বছর (২০১৭) সবজি উৎপাদন হয় ৪ লক্ষ ৪৮ হাজার মেট্রিক টন, আলু উৎপাদন হয় ১ কোটি ২ লক্ষ মেট্রিক টন। খাদ্য সংরক্ষণ ও প্রক্রিয়াজাতকরণ বিষয়ক আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে দেশে উৎপাদিত ফল, মূল শাক-সবজি ইত্যাদি সংরক্ষণ করে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন সম্ভব। পার্শ্ববর্তী দেশ থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া খাদ্য সংরক্ষণ ও প্রক্রিয়াজাতকরণে অনেক এগিয়ে গেছে।
৮। কুসংস্কার : সামাজিক কুসংস্কার আমাদের দেশে পুষ্টিহীনতার জন্য অনেকাংশে দায়ী; যেমন- গর্ভবতী ও প্রসূতি মাকে অনেক ধরনের খাবার খেতে দেওয়া হয় না যার বিজ্ঞানসমম্মত কোনো ভিত্তি নেই। মেয়ে অপেক্ষা ছেলেদেরকে পুষ্টিকর খাবার বেশি পরিমাণে দেওয়া হয়। অনেক এলাকায় প্রসূতি মাকে সুতিকা রোগ হওয়ার ভয়ে পুঁটিমাছ, ইলিশ মাছ ও গরুর মাংস খেতে দেওয়া হয় না। গ্রামের অনেক মা ও শিশুকে শুধু স্যালাইন ছাড়া অন্য কিছু খাওয়ানো হয় না। এ ছাড়াও বহু ধরনের কুসংস্কার পুষ্টিহীনতার জন্য দায়ী।
৯ । খাদ্যে ভেজাল : ভেজাল খাবার পুষ্টিহীনতা সৃষ্টির একটি অন্যতম উপায়। ব্যবসায়ীরা অতিরিক্ত মুনাফার জন্য তাদের নীতিবোধ বিসর্জন দিয়ে খাদ্যে ভেজাল দেয়। সয়াবিন তেলের সাথে পাম তেল, মিশ্রণ, সয়াবিন তেলের পরিবর্তে পোড়া মবিলে খাদ্য ভেজে বিক্রি করে। বিভিন্ন বাতিল রাসায়নিক পদার্থ দিয়ে জুস বা পানীয় তৈরি করা হয়। ইউরিয়া দিয়ে মুড়ি ভাজা, মাছ, মাংস ও দুধে ফরমালিন মেশানো, কার্বাইড দিয়ে ফল পাকানো ইত্যাদি। বিভিন্নভাবে ব্যবসায়ীরা খাদ্যে ভেজাল ও দূষিত রাসায়নিক পদার্থ মিশিয়ে পুষ্টিমানের চরম ক্ষতি করছে। এতে পুষ্টিহীনতার সৃষ্টি হচ্ছে এবং জনসাধারণ বিভিন্ন রোগবালাই দ্বারা আক্রান্ত হচ্ছে।
১০। প্রাকৃতিক দুর্যোগ : বন্যা, খরা, ঘূর্ণিঝড়, টর্নেডো, জলোচ্ছাস ইত্যাদির কারণে অনেক সময় অঞ্চল বিশেষে উৎপাদিত সম্পূর্ণ ফসলই নষ্ট হয়ে যায়। প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে ফসলের ক্ষতি হয়ে অনেক সময়ে দুর্ভিক্ষে রূপ নেয়। ফলে মানুষ পুষ্টিহীনতায় ভোগে।
১১। স্বাস্থ্য পরিচর্যা : স্বাস্থ্য পরিচর্যা হচ্ছে প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্য ব্যবস্থা যা একটি নির্দিষ্ট এলাকার সদস্যদের নিকট সহজলভ্য করে তোলা। অবশ্য পর্যাপ্ত খাদ্য উৎপাদান ও সুষম খাদ্যবণ্টন ও গ্রহণের পাশাপাশি প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরিচর্যা বাস্তবায়ন করা উচিত। নিরাপদ পানির ব্যবস্থা, স্যানিটারি পায়খানা ব্যবহার, সংক্রামক রোগ থেকে রক্ষা, বাসস্থান পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা, শিশুর ছয়টি টিকা দান, ও মায়ের দুধ খাওয়ানো ইত্যাদি ব্যবস্থা করা গেলে পুষ্টিহীনতা থেকে রক্ষা পাওয়া যেতে পারে।
অপুষ্টি সমস্যার সম্ভাব্য সমাধান
অপুষ্টি সমস্যা যেমন একদিনে সৃষ্টি হয় না তেমনি এর সমাধানও একদিনে করা সম্ভব নয়। পর্যায়ক্রমে বিভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে সমাজ থেকে অপুষ্টি দূর করা সম্ভব। পুষ্টিহীনতা দূর করার জন্য মোটামুটিভাবে যেসব ব্যবস্থা সাময়িকভাবে গ্রহণ করা সম্ভব তা নিম্নরূপ-
১. শস্যের বহুমুখীকরণ এবং আধুনিক কৃষি প্রযুক্তি ব্যবহার সম্বন্ধে কৃষকদের উৎসাহ এবং প্রশিক্ষণ প্রদান করা, যাতে বিভিন্ন শ্রেণির খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়ে খাদ্যের সরবরাহ এবং প্রাপ্যতা বৃদ্ধি পায় ।
২. বসতবাড়িতে হাস-মুরগি ও গবাদী পশু পালন এবং অধিক শাকসবজি ও ফল উৎপাদনের জন্য সবজি বাগান করা এবং ফলের গাছ লাগানো।
৩. বিভিন্ন মাধ্যমে প্রচার এবং প্রশিক্ষণ ব্যবস্থা অবলম্বন করে জনগণের মধ্যে ব্যাপকভাবে খাদ্য ও পুষ্টি এবং প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরিচর্যা সম্বন্ধে জ্ঞান দান করে সচেতনতা বৃদ্ধি করা ।
৪. উপজেলা বা ইউনিয়ন পর্যায়ে স্থায়ী প্রদর্শনী ও বীজ উৎপাদন খামার এবং প্রশিক্ষণ কেন্দ্ৰ স্থাপন করা। যাতে স্থানীয় চাহিদার ভিত্তিতে প্রয়োজনে কর্মসূচি প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করা যায়।
৫. শিক্ষা ব্যবস্থায় স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসার বিভিন্ন পাঠ্যসূচিতে পুষ্টি জ্ঞান ও প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরিচর্যাকে অন্তর্ভুক্ত করা ।
৬. দরিদ্রতা এবং ভূমিহীনতা রোধ করার জন্য একটি জাতীয় ভূমি বণ্টন ব্যবস্থাপনা অবলম্বন করা ।
৭. ভূমিহীনদের জন্য কাজের সুযোগ ও আয় বৃদ্ধিমূলক কর্মসূচি গ্রহণ করা যাতে তাদের পারিবারিক আয় ও ক্রয় ক্ষমতা বৃদ্ধি পায় ।
৮. প্রচলিত খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন করে অপ্রচলিত নতুন খাদ্য খাওয়ার অভ্যাস গড়ে তোলার কর্মসূচি, গ্রহণ করা। যেমন- মাশরুম, কাসাভা ইত্যাদি।
৯. এগ্রোবেসড শিল্পকে উৎসাহিত করার জন্য সহজ শর্তে ব্যাংক ঋণের ব্যবস্থা করা।
১০.দেশব্যাপী শিশুদের সংক্রামক ব্যাধি প্রতিরোধে নিয়মিত টিকাদান কর্মসূচি, ভিটামিন বিতরণ কার্যক্রম জোরদার করা ।
১১. পল্লী এলাকায় নিরাপদ পায়খানা, নিরাপদ পানির ব্যবস্থা করা এবং দরিদ্র লোকের জন্য স্বাস্থ্যকর বাসস্থানের কর্মসূচি গ্রহণ করা।
১২. সরকারি অনুদানের মাধ্যমে সকল স্কুলে ছাত্রদের জন্য স্বাস্থ্যসম্মত টিফিনের ব্যবস্থা করা।
১৩. দেশে জরুরি খাদ্য মোকাবেলার জন্য 'খাদ্য ব্যাংক' গঠনের পরিকল্পনা করা।
১৪. জাতীয় পর্যায়ে একটি সঠিক ও উপযুক্ত পুষ্টিনীতি গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করা।
Read more